জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন লালিত সোনার বাংলা তথা বিশ^ দরবারে উন্নত বাংলাদেশের আবির্ভাবের পর্যায়ে আমরা বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশ। আগামী ২০৪১ সালে বিশে^ উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। এ ছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ অর্জনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এসডিজি এর উল্লেখযোগ্য লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়া এবং প্রতিটি মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বর্তমান সরকারের গৃহীত নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ দুধ ও ডিম উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গবাদিপ্রাণি ও পোল্ট্রি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। মোট দেশজ উৎপাদনে প্রানীসম্পদ খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছাড়াও, দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি এবং প্রাণিজ আমিষ সরবরাহে এই খাতের ভূমিকা অনস্বীকার্য। চামড়াসহ বিভিন্ন উপজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
গবাদি প্রাণী ও পোলট্রি প্রজাতি
বাংলাদেশে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে ব্যবহৃত উল্লেখযোগ্য গবাদি প্রাণি ও পোলট্রি প্রজাতিগুলো হচ্ছে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ও হাঁস। দেশে প্রতি বছর গবাদি প্রাণী ও হাঁস-মুরগির সংখ্যা বেড়েই চলছে অর্থাৎ দেশে শিল্পায়ন, নগরায়ন ইত্যাদি হলেও জনগণ গবাদি প্রাণী পালন থেকে বিচ্যুত হয়নি।
জাতীয় অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান
স্থির মূল্যের ভিত্তিতে বিগত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল ১.৪৭%, যা টাকার অংকে প্রায় ৪৩২১২ কোটি টাকা। প্রাণিসম্পদ খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হার ছিল ৩.৪৭%। জাতীয় জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে কমলেও কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি মূল্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল ১৩.৪৬%।
প্রাণিজ আমিষ সরবরাহ
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সুপারিশ অনুযায়ী একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষের প্রতিদিন ন্যূনতম ২৫০ মিলি দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংস এবং বছরে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। উল্লেখ্য যে, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে দুধ, ডিম ও মাংস গ্রহণের পরিমাণ এফএও এর সুপারিশের চেয়ে অনেক বেশি। বর্তমান দেশজ উৎপাদন দুধ, মাংস ও ডিমের ন্যূনতম জাতীয় চাহিদার ৬৬.০৩, ১০৪.১৫ এবং ৯৯.৮৯% জোগান দিয়ে থাকে। বিগত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে ৩২২.৯১, ৪৯৬.৩৫ এবং ১৯৭.৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণে দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের চাহিদা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দারিদ্র্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন এবং আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি
দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২০% সরাসরি এবং ৫০% আংশিকভাবে জীবিকার জন্য প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এক টন দুধ উৎপাদন এবং ইহার প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাতের সাথে সম্পৃক্ত ৩৭টি শ্রমজীবী পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। উল্লেখ্য যে, প্রাণিসম্পদ খাত গ্রামীণ অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত মহিলাসহ বিপুলসংখ্যক বেকার যুবক-যুবতির কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
প্রাণিসম্পদ পণ্য ও উপজাত রপ্তানি
জাতীয় রপ্তানি আয়ের প্রায় শতকরা ২.৪৯ ভাগ অর্থাৎ ১.০১ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার সমপরিমাণ টাকা আসে বিদেশে চামড়া ও চামড়া জাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। সরকার দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভবিষ্যতে বিদেশে দুধ, মাংস ও ডিম রপ্তানি করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও প্রাণিজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান অর্জনের লক্ষ্যে মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার স্থাপনসহ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
টেকসই নিরাপদ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনে বিদ্যমান গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জসমূহ
প্রাণিসম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জসমূহ নি¤œরূপ :
কৃষি জমির স্বল্পতা: দ্রæত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য দেশে শিল্প বিকাশের বিকল্প নাই। শিল্প বিকাশের জন্য স্থাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত চাষাবাদযোগ্য জমি ব্যবহার হচ্ছে। ফলে দেশে প্রতি বছর ১% হারে কৃষি জমি অন্যান্য কাজে ব্যবহার হচ্ছে। এমতাবস্থায়, প্রাণিসম্পদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে দেশে দুধ, ডিম ও মাংসের জোগান নিশ্চিত করা দূরুহ হবে। কারণ প্রাণীর সংখ্যা বাড়ালে তাদের পালনের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা পাওয়া সহজ হবে না। সে ক্ষেত্রে দেশের চরাঞ্চলগুলোকে মিল্কভিটার আদলে প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ করা যেতে পারে।
দেশীয় প্রাণী ও পোলট্রি প্রজাতিসমূহের কম উৎপাদনশীলতা : দেশে বিদ্যমান গরুর প্রায় ৫০%, মহিষের ৯০%, ছাগলের ৬০% ও ভেড়ার ৮০% দেশী জাতের। দেশী জাতের এসব গবাদি প্রাণী ও পোলট্রি প্রজাতির উৎপাদনশীলতা অনেক কম। যা লাভজনক বাণিজ্যিক খামার ব্যবস্থাপনায় পালন উপযোগী নয়। দেশে বিদ্যমান সংকর জাতের গবাদি প্রাণীগুলোর উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও এদের রোগবালাই বেশি, বাচ্চা প্রদানের হার কম, পালন ব্যবস্থাপনা ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ খামারিদের জন্য সহজসাধ্য নয়।
প্রাণী ও পোলট্রি খাদ্যের ঘাটতি : আমাদের দেশে উৎপাদিত ধানের খড় গবাদি প্রাণীর আঁশ জাতীয় খাদ্যের জোগান দিয়ে থাকে। দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ খড় উৎপাদিত হয় তা দিয়ে আঁশ জাতীয় খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু অধিকাংশ খড় বর্ষা মৌসুমে উৎপাদিত হওয়ায় প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ সম্ভব না হওয়ায় চাহিদার প্রায় ৫৬% ঘাটতি থাকে। সা¤প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএলআরআই উদ্ভাবিত নেপিয়ার ফডার চাষ স¤প্রসারিত হচ্ছে। অন্যদিকে দানাদার খাদ্য হিসেবে মূলত বিভিন্ন শস্য উপজাত, শস্যদানা এবং খৈল ব্যবহার হয়ে থাকে। দেশে উৎপাদিত এসব খাদ্য উপাদান জাতীয় চাহিদার মাত্র ২০.৪০% জোগান দিয়ে থাকে।
রোগনির্ণয়, চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ : দেশীয় গবাদিপশু ও পোলট্রি প্রজাতিসমূহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং চিকিৎসা ব্যয় অনেক কম। অন্যদিকে সংকর এবং বিশুদ্ধ বিদেশী জাতের গবাদিপ্রাণি ও পোলট্রির বাংলাদেশের আবহাওয়া ও পালন ব্যবস্থাপনায় রোগব্যাধি বেশি হয়, মৃত্যুহার বেশি এবং জীবদ্ধশায় বাচ্চা উৎপাদনের সংখ্যা অনেক কম। এ ছাড়াও, দেশে প্রযুক্তি নির্ভর কার্যকর রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার ব্যবহার খুবই সীমিত পর্যায়ে।
প্রাণিসম্পদ পণ্যের বহুমুখী বিপণন ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশে গবাদি প্রাণী ও পোলট্রি খামার ব্যবস্থাপনায় উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যালু-এডেড পণ্য উৎপাদন এবং খামার উপজাতসমূহের রি-সাইকেলিং বা এ থেকে ভ্যালু এডেড পণ্য উৎপাদনের বিষয়টি উপেক্ষিত। এমতাবস্থায় শুধু দুধ, মাংস ও ডিম বিপণনের মাধ্যমে লাভজনক খামার পরিচালনা করা দুরুহ। এর পেছনে রয়েছে খামারিদের অসচেতনতা, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তির সহজ প্রাপ্যতা অন্যতম।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থাপনা: বাংলাদেশ বিশে^ সবচেয়ে বেশি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ুর প্রভাব প্রাণিসম্পদ পালন এবং উৎপাদনে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গাভীর দুধ উৎপাদন ১৪ থেকে ৩৫% কমে যায়। এমতাবস্থায়, পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে সহনশীল প্রাণী ও পোলট্রি পালন প্রযুক্তি উন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম।
শ্রমিকের প্রাপ্যতা: অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। দেশে শিল্পায়নের সম্প্রসারণের ফলে জনবলের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ায় কৃষি কাজে শ্রমিকের স্বল্পতা দেখা যাচ্ছে। ফলশ্রæতি ভবিষ্যৎ প্রাণিসম্পদ খামার ব্যবস্থাপনায় যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচ্য হবে।
আগামী ৫০ বছরে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে সম্ভাব্য গবেষণা ক্ষেত্রসমূহ
জলবায়ু ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য গবেষণা; প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় জীবপ্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত গবেষণা; প্রাণিসম্পদ উৎপাদন ব্যবস্থায় ন্যানো প্রযুক্তির প্রয়োগ বিষয়ক গবেষণার সূচনা; প্রাণিসম্পদ গবেষণা ও উন্নয়নে আইসিটি প্রয়োগ; প্রাণিসম্পদজাত খাদ্যপণ্য এবং উপজাত প্রক্রিয়াকরণ সংক্রান্ত গবেষণা জোরদারকরণ; ভ্যাকসিন ও বায়োলজিক্স সংক্রান্ত গবেষণা আধুনিকায়ন ও জোরদারকরণ; নুতন খাদ্য উদ্ভাবন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষণা জোরদারকরণ; জলবায়ু পীড়ন সহনশীল প্রাণী ও পোল্ট্রির জাত উন্নয়ন।
মানসম্পন্ন ও নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি পূরণে আঞ্চলিক কৃষি, কৃষক ও আবহাওয়াকে সম্পৃক্ত করে লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পরিবর্তনশীল প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় নতুন সমস্যাবলীর কার্যকর সমাধানের জন্য অঞ্চলভিত্তিক গবেষণা কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর জন্য দেশের গবেষণা সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।
ড. গৌতম কুমার দেব১ ড. নাথুরাম সরকার২
১ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বায়োটেকনোলজি বিভাগ, মোবা : ০১৭১৫২৩৪২৩, ই-মেইল : debgk2003@yahoo.com, ২মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট,